ট্রাম্প পানামা খাল দখল করতে চায় কেন

hqdefault (7)
সত্যের খোঁজে

ট্রাম্প পানামা খাল দখল করতে চায় কেন

ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে দখলদারী মনোভাব পোষণ করে আসছিল। ক্ষমতা গ্রহণের দিন উদ্বোধনী ভাষণেই ট্রাম্প পানামা খাল দখেলে নেওয়ার বিষয়ে জোড়ালো মন্তব্য করেন। এছাড়ও গ্রীনলান্ড দ্বীপ বা কানাডার মত দেশ দখল করে যুক্তরাষ্ট্রের মানচিত্রে অন্তর্ভূক্ত করার মত নানা বিষয়ে ট্রাম্প একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করেই চলেছে।

পানামা খাল কিভাবে তৈরী করা হয়েছিল, এই খাল কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ট্রাম্প কেন পানামা খাল দখল করতে চায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।

পানামা খালের গুরুত্ব

বিশ্ব বাণিজ্য ও রাজনীতিতে পনামা খাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই খালটি একই সাথে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশকে পৃথক করেছে এবং আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরকে সংযুক্ত করেছে। সমগ্র বিশ্ব বানিজ্যের প্রায় ৫ শতাংশ সম্পন্ন হয় পানামা খাল দিয়ে। 

অতীতে আর্জেন্টিনার কেপ হর্ণের জলপথ ঘুরে, আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যেতে নৌযানভেদে সময় লাগত প্রায় ২ থেকে ৬ মাস। পরবর্তীতে পানাম খাল তৈরী হবার পর মাত্র ২০-৩০ ঘন্টার মধ্যেই আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে যাতায়াত করা যায়।

১৫৩৪ সালে সর্বপ্রথম স্প্যানিশ প্রকৌশলীরা একটি জরিপ করে, আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর জন্য পানামায় একটি খালের প্রস্তাব দেন। তৎকালীন সময়ের নির্মান পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতার কারনে এই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। 

প্রথম খাল খনন চেষ্টা

তৎকালীন সময়ে পানামা ছিল কলম্বিয়ার অংশ। ১৮৫৯ সালে মিশরের মরুভূমির মধ্য দিয়ে সুয়েজ খাল নির্মাণ প্রকল্প সম্পন্ন হবার পর পানামা খাল নিয়েও আলোচনা শুরু হয়। কিন্তু মরুভূমির মাঝে সুয়েজ খাল খনন আর, পানামার পাহাড়ি জঙ্গলে খাল নির্মাণ এক বিষয় নয়। সেই সাথে পানামার এই জঙ্গলে ছিল আগ্নেয় শিলার স্তুপ, দুরারোগ্য ব্যাধির সংক্রমন, হিংস্র বন্যপ্রাণী এবং বিষাক্ত পোকামাকড় সহ নানা রকমের প্রতবন্ধকতা। তাই পানামা খাল খনন করাটা, সুয়েজ খাল খননের চেয়েও অনেক বেশি কঠিন ছিল। 

১৮৮১ সালে একটি ফ্রেঞ্চ কোম্পানি ক্যারিবিয়ান ও ইন্ডিয়ান শ্রমিকদের দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করার মাধ্যমে পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে। জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে ইয়েলো ফিভার আর ম্যালেরিয়া সহ বিষাক্ত পোকামাকড়, আর সাপের কামড়ে প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার মারা যায়। সেসময় গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জন শ্রমিক মারা যেতে থাকে। এছাড়া পানামার পর্বতময় এলাকার ভেতর দিয়ে খাল খনন করতে গিয়ে নিয়মিত ভূমি ধ্বস হতে থাকে। ফলে এক পা আগালে তিন পা পিছিয়ে আসতে হচ্ছিল। ম্যালেরিয়ার বিস্তার আর মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতির কারনে ১৮৮৯ সালে, ২০ হাজারেরও বেশী কর্মীর লাশ পেছনে ফেলে, ফ্রেঞ্চ কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে পানামা খাল খননের কাজে ইস্তফা দেয়। সেই বিশাল ব্যর্থতায় ফ্রান্স সরকারের প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।

পানামা খাল খনন

১৮৯৮ সালে স্প্যানিশ আমেরিকান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জয়ী হলেও, আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৈন্য পরিবহণ ও রসদ সরবারাহের ক্ষেত্রে আমেরিকানরা বেশ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছিল। সেকারণে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট নতুন করে পানামা খাল খনন করার পরিকল্পনা করেন।

তখনও পর্যন্ত কাগজে কলমে পানামার মালিক ছিল কলম্বিয়া। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কলম্বিয়ার সাথে কোন চুক্তি না করে, পানামার বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনা করতে থাকে। ১৯০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামার বিদ্রোহী গোষ্ঠী কে প্রস্তাব দেয়: তারা যদি যুক্তরাষ্ট্রকে পানামার উপর খাল খননের অনুমতি দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র পানামা কে কলম্বিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করবে। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ খবরদারিতে রক্তপাত বিহীন এক বিদ্রোহের মাধ্যমে পানামা স্বাধীনতা লাভ করে। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল এলাকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখানে একটি মার্কিন ছিটমহল গড়ে তোলে। এবং ১৯০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে।

পানামা খালের প্রযুক্তি

আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর কে সংযুক্ত করার জন্য পানামা খাল খনন করা হলেও, পানামার এই অঞ্চলের ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বেশ উঁচুতে অবস্থিত। সেকারণে পানামার দুই প্রান্তে বেশ কিছু লক বা জলকপাট নির্মাণ করা হয়। এগুলো অনেকটা পানি দিয়ে তৈরী জাহাজের লিফটের মত কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে জাহাজগুলোকে পর্যায়ক্রমে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার বা প্রায় ৭ তলার সমান উঁচুতে তোলা হয়। 

তবে পানামা খালের সমস্ত অংশই খাল খননের মাধ্যমে তৈরী করা হয়নি। এই অঞ্চলে প্রবাহিত চার্গেস নদীতে বাঁধ দিয়ে, গাটুন নামে এখানে একটি কৃত্রিম হ্রদ সৃষ্টি করা হয়। বাঁধের পানি দিয়ে প্লাবিত ১৬৪ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত গাটুন হ্রদ; তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে বড় কৃত্রিম হ্রদ হিসেবে স্বীকৃত ছিল। এই হ্রদ থেকে আবারো বেশ কিছু জলকপাটের মাধ্যমে, জাহাজগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরের জলের স্তরে নামিয়ে আনা হয়।

পানামা খাল তৈরী করতে এখানকার কুলেবড়া পর্বতকে ৮ মাইল লম্বা, ৩০০ ফিট চওড়া ও ৫০ ফিট গভীর করে খনন করা হয়। দুসাধ্য এই কাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ২৭ হাজার শ্রমিক মারা যায়। অবশেষে ১৯১৪ সালের ৩ অগাস্ট, পানামা খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল শুরু হয়।

পানামা খালের বাণিজ্যিক এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে পানামার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র পানামায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে, পানামাবাসী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে।

এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি পেলে, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার পানামা খাল হস্তান্তর চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এবং তার প্রায় ২২ বছর পর ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পানামাবাসী পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তখন থেকে দেশটির সরকারী প্রতিষ্ঠান পানামা ক্যানাল অথরিটি খালটি ব্যবস্থাপনার দ্বায়িত্ব পালন করে আসছে।

ট্রাম্প দখল করতে চায় কেন

যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পানামা খাল খনন করেছিল, তাই বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন পানামা খাল আবারো যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসা উচিত। তাছাড়া ট্রাম্পের যুক্তি হল, পানামা খালে মার্কিন জাহাজ চলাচলে অধিক শুল্ক আরোপ করা হয়, এবং পানামা সরকারকে হাত করে, চীন কৌশলে এই খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। সেকারণেই ট্রাম্প আবারো পানামা খালকে মার্কিন সরকারের দখলে আনতে চায়। ট্রাম্প তার উদ্বোধনী ভাষণেও এ বিষয়ে হুমকি দিয়েছেন।

ট্রাম্প শুধু মৌখিক হুমকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সে অনেকটা পদক্ষেপও নিতে শুরু করেছে। সাধারণত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা প্রথমে বড় বড় মিত্রদেশগুলোতে সফর করেন। তবে ট্রাম্পের পররাস্ট্র মন্ত্রী মার্কো রুবিও তার প্রথম সফরেই পানামায় গেছেন। 

বর্তমানে বছরে প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি নৌযান পনামা খাল দিয়ে যাতায়াত করে। যা পানামার জাতীয় অর্থনীতির ৬ শতাংশের জোগান দেয়। পানামা খাল দিয়ে চলাচলকারী জাহাজের ৭৪ শতাংশই মার্কিন জাহাজ। এরপরই রয়েছে চীনের অবস্থান। পানামা খালে চলা প্রায় ২১ শতাংশ জাহাজ চীনের। 

পানামার প্রেসিডেন্ট হোসে রাউল মুলিনো বলেছেন, ‘খালটির ওপর চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।’ সকল ধরনের নৌযান, এমনকি যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিন এই খাল দিয়ে চলাচল করতে পারে।

পানামার সাথে চুক্তির মাধ্যমে খাল নির্মাণের সময় থেকে প্রায় ১০০ বছর যুক্তরাষ্ট্র এখানে এক ধরনের ছিটমহল তৈরী করে রেখেছিল। পানামার মধ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের সেই ছিটমহলে, মার্কিন সামরিক ঘাঁটি, পুলিশ, এমনকি মার্কিন আদালত পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প তার স্বভাবসুলভ আগ্রাসনের মাধ্যমে, পানামা খালে চীনের দখলদারির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে, বিশ্ব বানিজ্যের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পানামা খাল আবারো দখল করতে চাইছে।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Select the fields to be shown. Others will be hidden. Drag and drop to rearrange the order.
  • Image
  • SKU
  • Rating
  • Price
  • Stock
  • Availability
  • Add to cart
  • Description
  • Content
  • Weight
  • Dimensions
  • Additional information
Click outside to hide the comparison bar
Compare
আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।