ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল কতটা ভয়াবহ

hqdefault (6)
সত্যের খোঁজে

ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল কতটা ভয়াবহ

ভূমিকা

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে এক ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। শুষ্ক আবহাওয়া, মরুভূমির তীব্র বাতাস এবং দীর্ঘস্থায়ী খরার ফলে এই আগুন একের পর এক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। লস অ্যাঞ্জেলেসের প্যাসিফিক প্যালিসেডস থেকে শুরু হওয়া এই দাবানল এখনও পর্যন্ত যে পরিমাণ এলাকা পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে, তার আয়তন সমগ্র ঢাকা শহরের আয়তনের চেয়েও প্রায় ২০ শতাংশ বেশি। বিশাল এই বিপর্যয় একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে দেখা হলেও, এর পেছনে মানবসৃষ্ট কারণও থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দাবানল আসলে কী, দাবানল কিভাবে তৈরী হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার এই দাবানল এতটা মারাত্নক হয়ে উঠল কেন সে সম্পর্কে আলোচনা করা হবে কিকেনকিভাবে র এই পর্বে।

দাবানল কী?

সাধারণত বনাঞ্চলে সংঘটিত অগ্নিকান্ডকে দাবানল বলা হয়। দাবানল সৃষ্টি হবার মত শুষ্ক পরিবেশে কোন বনে আগুন লাগলে, তা সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বনের ঝড়া পাতা থেকে শুরু করে ছোট বড় সকল বৃক্ষ এই আগুনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে থাকে। ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার গতিতে চলতে সক্ষম এই আগুন সামনে যা কিছু পায়, সবকিছু পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। সেকারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাবানলের আগুন আপন মনে যতক্ষণ খুশি জ্বলতে থাকে। তবে অধিকাংশ সময়ই এই আগুনের সূত্রপাত হয় মানুষের দ্বারা। ইউএস ফরেস্ট সার্ভিসের তথ্য মতে, আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকে। অযত্নে ফেলে রাখা ক্যাম্পফায়ারের আগুন বা সিগারেটের আগুন এর মত, মানুষের অসতর্ক আগুন থেকে সবচেয়ে বেশি দাবানল সৃষ্টি হয়। কোন কোন গবেষক বলেন, মাত্র ১ শতাংশ দাবানল প্রাকৃতিক আগুন থেকে তৈরী হয়। এগুলো মধ্যে বজ্রপাত এবং আগ্নেয়গিরির আগুনই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। 

দাবানল কিভাবে তৈরী হয়?

সমগ্র আমেরিকার বনাঞ্চলে বিভিন্ন উপায়ে বছরে প্রায় এক লক্ষ বার আগুন লাগে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ হেক্টর জমি পুড়ে যায়। গত তিরিশ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনআফ্রিকার কঙ্গোর রেইন ফরেস্ট এলাকা এবং ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের লক্ষ লক্ষ একর এলাকার বনভূমি মানব সৃষ্ট দাবানলে ধ্বংস হয়েছে। সাধারণত চাষাবাদের নতুন জমি সৃষ্টি করার জন্য বনে আগুন দেওয়ার পর, এসব দাবানল সৃষ্টি হয়। 

দাবানলের ক্ষতিকর প্রভাব আক্রান্ত অঞ্চল ছাড়াও আরো বহু দূর ছড়িয়ে পড়ে। দাবানলের আগুন থেকে অগ্নি ঝড়, আগুনে সাইক্লোন বা আগুনের টর্নেডোও তৈরী হতে পারে। যা নদীর মত বাঁধা পার করেও দাবনলকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দাবানলের ধোাঁয়া ও ছাইও অনেক দূরবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। 

সাইবেরিয়ার তাইগা বনে তৈরী হওয়া দাবানলের ধোঁয়া ৩ হাজার মাইল দূরে জাপানের ওসাকা শহরকে অন্ধকার করে দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার ব্ল্যাক ফ্রাইডে বুশ-ফায়ারের ছাই ২ হাজার মাইল উড়ে গিয়ে নিউজিল্যান্ডে পড়েছিল। 

দাবানল মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক যেভাবেই হোক না কেন, প্রথমত এটি ক্ষতিকর রূপ নিলেও, এ ভেতরে বেশ কিছু কল্যাণকর দিকও আছে। দাবনলের কারণে বনের মৃত ও পচনশীল দ্রব্যাদি পুড়ে গিয়ে পরিবেশ শুদ্ধ হয়। গাছের কাণ্ডে জমে থাকা পুষ্টি, অগ্নিকান্ডের পরে আবারো জমিতে ফেরত আসে। এছাড়া যাবতীয় ক্ষতিকর পোকামাকড় এবং রোগশোকের জীবাণুও ধ্বংস হয়ে যায়; যার ফলে নির্দিষ্ট সময় পর বনের বাস্তুসংস্থান আবারো নতুন করে গড়ে ওঠে।

ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল

সাম্প্রতিক সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় যে দাবানল সৃষ্টি হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের ইতহাসের অন্যতম ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একটি বিষয় পরিষ্কার করা জরুরী, আর তা হল, ক্যালিফোর্নিয়ায় তৈরী হওয়া দাবানল কোন একক দাবানল নয়। কাছাকাছি সময়ে প্রায় ৫টি ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় দাবানল তৈরী হয়েছে। প্রথম দাবানল শুরু হয়েছিল প্যালিসেডসে, এরপর ইটন, হার্স্ট, লিডিয়া এবং কেনেথ এলাকায় একের পর এক দাবানল ছড়িয়ে পড়েছে। সেকারণেই দাবানল পরিস্থিতি ক্যালিফোর্নিয়ায় এতটা ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে এসেছে। 

যেহেতু দাবানল সৃষ্টি হবার প্রায় চার দিন পেরিয়ে গেলেও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি; তাই এর প্রকৃত ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। এই দাবানলে ইতোমধ্যেই অন্তত ১১ জন মারা গেছেন, ১০,০০০-এরও বেশি ঘরবাড়ি এবং স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে, এবং ১,৫৩,০০০-এরও বেশি মানুষকে তাদের এলাকা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

এই দাবানল প্রথম শুরু হয়েছিল প্যাসিফিক প্যালিসেডস এলাকায়, সেখানে এখন পর্যন্ত ২১,০০০ একরের বেশি জমি পুড়ে গেছে। এছাড়া ইটন দাবানল প্রায় ১৪,০০০ একর জমি ধ্বংস করেছে। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দাবানলগুলোর মধ্যে হার্স্ট দাবানলে ৭৭১ একর, লিডিয়া দাবানলে ৪০০ একর এবং কেনেথ দাবানলে ১,০০০ একর জমি পুড়ে গেছে।

ক্যালিফোর্নিয়া এমনিতেই দাবানলপ্রবণ এলাকা। ক্যালিফোর্নিয়ার ভূমি এবং আবহাওয়া দাবানলের জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড়ি এলাকা এবং ঘন গাছপালা দাবানলের বিস্তারকে সহজ করে তোলে। শুষ্ক ঘাস, ঝোপঝাড় এবং গাছপালা দ্রুত জ্বলে ওঠার কারণে আগুন সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, তারা অতীতে ক্যালিফোর্নিয়ার পাহাড় এবং বনাঞ্চলে দাবানলের আগুন দেখেছেন, কিন্তু এবার তারা চোখের সামনে দাবানলে তাদের শহর পুড়ে যেত দেখল।

কেন এত ভয়াবহ হল

ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল এত দ্রুত ছড়ানোর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘস্থায়ী খরা, শুষ্ক আবহাওয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি অঞ্চল থেকে আসা তীব্র বাতাস। এই বাতাসকে সান্তা আনা বাতাস নামে অভিহিত করা হয়। যার গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কিমি পর্যন্তও পৌঁছেছে। এই ঝড়ো বাতাসই মূলত আগুনকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে।

দাবানল শুরু হওয়ার কারণ এখনও তদন্তাধীন রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, ক্যালিফোর্নিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় উদ্ভিদ এবং ভূমি অত্যন্ত শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল, যা আগুন ছড়ানোর জন্য আদর্শ পরিবেশ তৈরি করেছে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তীব্র বাতাসের প্রভাবে বিদ্যুতের তার ঝুলে পড়ে, তখন বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুন শুরু হতে পারে। তবে প্রাথমিক তদন্তে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। তবে সমগ্র আমেরিকার প্রায় ৮৫ শতাংশ দাবানল মানুষের কারণে হয়ে থাকলেও, ক্যালিফোর্নিয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ দাবানলের আগুনই মানবসৃষ্ট।

৭,৫০০ অগ্নিনির্বাপক কর্মী এবং ন্যাশনাল গার্ড ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানলের আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। তবে পানির সংকট এবং বাতাসের উচ্চ গতি দাবানল নেভানোর প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে। তাছাড়া অগ্নি নির্বাপনে পানি সরবরাহের জন্য ব্যবহৃত ফায়ার হাইড্রেন্ট গুলোতে পর্যাপ্ত পানির চাপ ছিল না। এরই মধ্যে আবার দাবানল তৈরী হবার কয়দিন আগে, প্যাসিফিক প্যালিসেডসের একটি গুরুত্বপূর্ণ জলাধার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, গত মাসেই ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলস ফায়ার ডিপার্টমেন্টের জন্য ৭ মিলিয়ন ডলার বাজেট কর্তন করা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে দাবানল তৈরী হবার মাত্র ২০ দিন আগে, এখানকার ফায়ার ডিপার্টমেন্ট এর প্রধান উচ্চপদস্থ  কর্মকর্তাদের চিঠি লিখে সতর্ক করেছিলেন যে, বাজেট কাটছাঁটের কারণে দাবানল, বন্যা, ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউসম এসব বিষয়ে স্বাধীন তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তারমানে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল যদি সরাসির মানবসৃষ্ট কারণে নাও ঘটে থাকে, তবে মানুষের অদূরদর্শী আচরণের কারণে তা আরো বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে দাবানলের সরাসরি সংযোগ রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দীর্ঘ খরা এবং বৃষ্টির অনিয়মিত চক্র পশ্চিম যুক্তরাষ্ট্রে এমন বিপর্যয়ের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। এই সঙ্কট আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো, এই মুহুর্তে ‍পৃথিবীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

Leave your thought here

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Select the fields to be shown. Others will be hidden. Drag and drop to rearrange the order.
  • Image
  • SKU
  • Rating
  • Price
  • Stock
  • Availability
  • Add to cart
  • Description
  • Content
  • Weight
  • Dimensions
  • Additional information
Click outside to hide the comparison bar
Compare
আপনার সঠিক - নাম, ইমেইল দিয়ে
Sign Up এ ক্লিক করুন।